শেয়ার বাজার হলো এমন একটি বাজার ব্যবস্থা যেখানে বিভিন্ন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি তাদের প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বিক্রি করে বিনিয়োগ বা পুজি সংগ্রহ করে। তাই একে পুঁজিবাজার বলা হয়। একটি দেশের শেয়ার মার্কেট বা পুঁজিবাজার যখন অনেক ভালো অবস্থানে থাকে তখন মনে করা হয় ওই দেশের অর্থনীতিও অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। শেয়ার বাজার কিভাবে কাজ করে তা নিয়েই আলোচনা করা হবে আজকের লেখায়। বর্তমান বিশ্বের বহু বিখ্যাত কোম্পানি তাদের শেয়ার জনসম্মুখে কেনাবেচা করে। কিন্তু অতীতের বিষয়গুলো এমন ছিল না। আগে সাধারণত একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তির মালিকানায় থাকতো। কিন্তু এককভাবে একটি ব্যবসা দাঁড় করাতে প্রচুর সময় ও অর্থের প্রয়োজন হয়। এজন্য বিংশ শতাব্দী শুরুতে পুরনো ধারা পাল্টাতে থাকে। কোম্পানির মালিকেরা লক্ষ্য করেন যে তারা যদি তাদের ব্যবসায় জনসাধারণকে উদ্ভূত করতে পারেন তাহলে খুব অল্প সময়ে ব্যবসায় লাভবান হওয়া যাবে। সেখান থেকেই শেয়ারবাজার ব্যবসার ধারণা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য তাদের মূলধনকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে এবং এসব এক একটি ভাগ জনগণের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং এর প্রতিটি অংশকে একটি শেয়ার বলা হয়। বহু কোম্পানির শেয়ার একসাথে বেচাকেনার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় শেয়ারবাজার বা স্টক মার্কেট।
মনে করুন আপনি একটি ব্যবসা শুরু করতে চান। আপনি সাধারণ মানুষের কাছে একটি প্রাথমিক অফার বা প্রস্তাব রাখবেন। একে বলা হয় আইপিও (IPO)। প্রস্তাবটি হলো যে কেউ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে আপনার ব্যবসার একটি ছোট অংশ বা মালিকানা কিনতে পারবে। এই টাকা দিয়ে আপনি আপনার ব্যবসা বড় করবেন। ব্যবসায় যখন লাভ আসা শুরু করবে তখন আপনার ব্যবসার পরিসর আরো বাড়াতে পারেন কিংবা নতুন কোন পণ্য ব্যবসায় যুক্ত করতে পারেন। অথবা আপনি চাইলে আপনার ব্যবসার শেয়ার হোল্ডারদের তাদের বিনিয়োগের কিছু অংশ ফেরত দিতে পারেন। একে বলা হয় Dividend। বিনিয়োগ যে ফেরত দিতেই হবে বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু বিনিয়োগ ফেরত দেয়ার মাধ্যমে অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আপনার ব্যবসা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হবে। এই আগ্রহ থেকে আপনার কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের থেকে নতুন বিনিয়োগকারীরা পূর্বের শেয়ার প্রায় দ্বিগুণ বা আরো বেশি দামে কিনে নিবে। নতুন বিনিয়োগকারীরা ভাবছে সময় সূযোগ হিসেবে তারাও আবার এই শেয়ার দ্বিগুণ বা আরো বেশি দামে বিক্রি করে দিবে। এভাবে কোন কোম্পানির শেয়ার বারবার কেনাবেচা করাই হলো শেয়ার বাজারের কাজ।
সারা পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে হাজার হাজার শেয়ার বেচাকেনা হচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শেয়ারবাজার রয়েছে। বাংলাদেশে আছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং চিটাগাং স্টকে চেঞ্জ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজার হচ্ছে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ। ১৭৯২ সালে নিউইয়র্ক টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ শেয়ার বাজার হলো Nasdaq। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ার বাজারের ভৌগোলিকভাবে কোন অবস্থান নেই। এটি অনলাইনে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হয়। এখন ফেসবুকের মত টেকজান্ড কোম্পানি গুলো শেয়ার Nasdaq এ লেনদেন করা হয়। শেয়ার হোল্ডার বা অংশীদারদের মূল উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন করা। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পরিচালক বা সিইও এর একটি ভুল সিদ্ধান্ত সেই প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য করে। এবং সাথে সাথে শেয়ারের দামও কমে যায়। উল্টোদিকে ধারাবাহিক সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কারী পরিচালকের নতুন বা ভিন্নধর্মী সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা আরো বেশি উৎসাহ দেখায়। এভাবে কোম্পানিগুলোর উপর সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার একটি চাপ সৃষ্টি হয়। যাতে তারা তাদের অংশীদারদের আরো বেশি টাকা বা ডিভিডেন্ড ফেরত দিতে পারে। এই চাপতে কি তারা ব্যবসায়ী উন্নতি লাভ করে সাথে সাথে জনগণেরও উন্নয়ন হয়। বর্তমান সময়ের একজন অন্যতম বিখ্যাত নিয়োগ কারী হচ্ছেন আমেরিকার ওয়াইন বাফেট। বর্তমানে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ৮৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বিনিয়োগ করে বিখ্যাত হওয়ার পিছনে বাপের একটি নিজস্ব ধরনের রয়েছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট শিলার এর মতে সকল বিনিয়োগকারী হবার জন্য দুই ধরনের পথ রয়েছে। প্রথমত আপনার কি কোন কোম্পানিতে বি নিয়োগ করার আগেই সেই কোম্পানির বিনিয়োগের পূর্বের ইতিহাস ভালো করে জানতে হবে এবং কোম্পানির ব্যবসা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধারণা রাখতে হবে। যা বেশ কষ্টসাধ্য। আর দ্বিতীয় পন্থাটি হলো ফরেন বাফেটের পদ্ধতি। ওয়ারেন বাফেট ইনডেক্স ফান্ডে বিনোয়গ করার মাধ্যমে মাল্টিমিলিয়নিয়রে পরিণত হয়েছেন। নির্দিষ্ট তালিকাভুক্ত বহু কোম্পানিতে একটু একটু করে বিনিয়োগ করাই হলো ইনডেক্স ফান্ড। এ পদ্ধতিতে লাভবান হওয়া সম্ভাবনা অনেক বেশি। ওয়ারেন বাফেট কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি যে এত সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করে বিশ্বের নামকরা ধনী ব্যক্তির তালিকায় নাম করে নিয়েছেন তাহলে অন্যরা আপনার এই পন্থা অনুসরণ করছে না কেন? উত্তরে বাফেট বলেন কারণ কেউ ধীরে ধীরে বড়লোক হতে চায় না৷ তার মানে ইনডেক্স ফান্ডে বিনিয়োগ করলে আপনি লাভবান হবেন নিশ্চিত তবে সে জন্য বেশ সময় লাগবে। একজন নতুন বিনিয়োগকারির জন্য একটি কোম্পানির শেয়ার কিনা আপাতত দৃষ্টিতে কঠিন ব্যাপার। কোন কোম্পানি কতটা জনপ্রিয় তার সাথে সেই কোম্পানির শেয়ারের দামের মিল নাও থাকতে পারে। অনেক সময় মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া গল্পের উপর ভিত্তি করে কোন কোম্পানির শেয়ারের দাম বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এসব ক্ষেত্রে কোম্পানি কোন কোন সময়ে হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের দাম হারিয়ে লোকসানের শিকার হয়। সেই সাথে তাদের বিনিয়োগকারির ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাথে সেই দেশের অর্থনীতিও হুমকির মুখে পড়ে।
আপনি কি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইওর এর উপর এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ওঠানামা করে অনেক সময় সাথে সিইও এর বেতনও কমবেশি করা হয়। এজন্য সিইওরা বাধ্য হয়েই এমন ব্যবসায়ীক সিদ্ধান্ত নিতে চান যাতে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০ এর দশকে একজন সি ই ও এর বেতন ছিল একজন সাধারণ কর্মচারীর তুলনায় ২২ গুণ বেশি। ২০১৬ সালের পর থেকে একজন সিইও একজন সাধারন কর্মচারী থেকে ২৭১ গুণ বেশি বেতন পান। এ থেকেই বুঝা যায় সিইও রা শেয়ার বাজারে নিজের কোম্পানির শেয়ার কে চাঙ্গা রাখতে কি পরিমান মরিয়া হয়ে থাকেন। একজন সিইওএর সঠিক সিদ্ধান্তের ফলে কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী উভয়ই লাভবান হয়। আমার অনেক সময় কোম্পানির কর্মচারীদের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও শুধুমাত্র শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করার জন্য বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শেয়ারের দাম বৃদ্ধির জন্য এমনকি কর্মী চাটাই, কারাখানা বন্ধ রাখার মত সিদ্ধান্তও কোম্পানির সিইওরা প্রায়শই নিয়ে থাকেন৷ অনেকসময় কোম্পানির নিজেদের লোকেরাই বেশি বেশি শেয়ার কিনে শেয়ারের কৃত্রিম সংকট তৈরী করে থাকে। ফলে ওই কোম্পানির শেয়ারের দাম হুট করে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে এ ধরনের কৃত্রিম সংকট বেশ কয়েকবার ঘটেছে। হঠাৎ করেই দেখা গিয়েছে শেয়ার বাজারের দাম হুট করেঅনেক বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু তার কিছুদিন পরেই শেয়ার বাজারে বিপুল ধ্বস নামে। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে এক ধরণের নৈরাজ্য বিরাজ করেছে। এই সময়ের দরপতন ইতিহাসের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। তখন দেশের অর্থনীতির প্রায় দুই লক্ষ কোটি টাকার লোকসান হয়।
পরবর্তীতে শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে আরও বিস্তারিত লেখায় বাকি অংশ বুঝানো যাবে৷ বা কিভাবে বিনিয়োগ করবেন শেয়ার মার্কেটে এ সম্পর্কে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানতে আমাদের সাইট এ নিয়মিত আপডেট দেখুন।
সুন্দর গোছানো লিখা।